মেলবোর্নে এক মহা দুর্গোৎসবের গৌরবগাথা
২০০৪ সাল থেকে Bengali Puja and Cultural Society of Victoria (BPCSV) মেলবোর্নে দুর্গোৎসবের মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও সমাজের বন্ধনকে নতুন করে রচনা করে চলেছে।
দীর্ঘ দুই দশকের এই ঐতিহ্যে, BPCSV দুর্গাপুজো আজ ভিক্টোরিয়ার অন্যতম বৃহৎ ও সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে — যেখানে ভক্তি, আনন্দ ও ঐক্যের সুরে মিশে যায় মেলবোর্নের বহুসাংস্কৃতিক সমাজ।
ভক্তি ও আতিথেয়তার এক অনন্য মেলবন্ধন
প্রতিবছরের মতো এবছরও আমাদের দুর্গাপুজোয় অংশ নিয়েছেন হাজারো ভক্ত ও শুভানুধ্যায়ী।
আমরা গর্বিত যে প্রায় ২০০০ ভক্তের জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ভোগ পরিবেশন করা হয়েছে, যা অন-সাইটে পেশাদার রাঁধুনিদের হাতে সদ্য রান্না করা।
ভাত, খিচুড়ি, ল্যাবড়া, পায়েস, চাটনি, পাপড় – প্রতিটি পদে ছিল ভালোবাসা, সেবার মানসিকতা ও দেবীর আশীর্বাদ।
এ যেন মেলবোর্নের মাটিতে এক বিশাল বাঙালি পরিবারের মিলনোৎসব।
ষষ্ঠী – দেবীর আগমনের আনন্দ
উৎসবের সূচনা হয়েছিল শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় ষষ্ঠী পূজা ও প্রসাদ বিতরণের মাধ্যমে।
ঘণ্টা, শঙ্খ, ধূপের গন্ধ ও ঢাকের আওয়াজে ভরে উঠেছিল মেলবোর্নের আকাশ।
এই দিনটি ছিল দেবী দুর্গার আগমনের আনন্দে ভক্তিময় ও শান্তিপূর্ণ এক সূচনা।
শনিবার – সংস্কৃতির প্রাণ, সৃষ্টির উচ্ছ্বাস
শনিবার সকাল ৯টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত চলেছিল পুজোর প্রধান আচার-অনুষ্ঠান।
এদিন পালিত হয় সপ্তমী ও অষ্টমীর পূজা, সঙ্গে ছিল দেবী ভোগ ও সম্প্রদায়ভোজের উৎসব।
দুপুরের খিচুড়ি ভোগ ছিল সকলের প্রিয় – গরম গরম খিচুড়ি, ল্যাবড়া, পায়েস ও চাটনির গন্ধে ভরে উঠেছিল প্যান্ডেল।
সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল এক অসাধারণ থিমভিত্তিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যা এবছরের প্রধান আকর্ষণ।
এই অনুষ্ঠানটির ধারণা ও সৃজনশীল পরিকল্পনা করেন শিল্পী দে, যিনি একজন প্রতিভাবান সংগীতশিল্পী ও সৃজনশীল চিন্তক।
তাঁকে সহযোগিতা করেছেন চঞ্চল, কান্তা, মৌ ও রাজীব, যাঁদের নিরলস প্রচেষ্টায় মঞ্চ জীবন্ত হয়ে উঠেছিল সুর, নৃত্য ও নাট্যের অনবদ্য মেলবন্ধনে।
এমন থিমভিত্তিক প্রোগ্রাম শেষবার আয়োজিত হয়েছিল ২০১৬ সালে।
এবারের এক ঘন্টা চল্লিশ মিনিটের মঞ্চনাট্য-গীতি দর্শকদের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।
পুরো চিত্রনাট্য ও স্ক্রিপ্টটি রচনা করেছেন BPCSV-এর সাংস্কৃতিক সম্পাদক শ্রী রাজীব দত্ত, যিনি চমৎকারভাবে বাঙালির ঐতিহ্য, সমাজচেতনা ও দেবী মহিমাকে মঞ্চে রূপ দিয়েছেন।
রবিবার – নবমী ও বিজয়ার আবেগঘন সমাপ্তি
রবিবার পালিত হয়েছিল নবমী ও বিজয়া দশমীর পুজো।
দিনভর আচার-অনুষ্ঠান শেষে শুরু হয়েছিল উৎসবের চূড়ান্ত আনন্দ —
র্যাফেল ড্র, র্যাম্প ওয়াক, সিঁদুর খেলা, ডিজে ডান্স, ধুনুচি নাচ – সব মিলিয়ে দেবী বিদায়ের দিনে এক রঙিন, আবেগঘন ও আনন্দে ভরা পরিবেশ।
ভক্তদের চোখে জল, মুখে হাসি — দেবীকে বিদায় জানিয়ে সবাই যেন নতুন শক্তি ও আশীর্বাদে ভরে উঠেছিলেন।
মঞ্চসজ্জা ও শিল্পনির্দেশনা – সৃজনশীলতার ছোঁয়া
পুরো অনুষ্ঠানের মঞ্চসজ্জা ও ভিজ্যুয়াল কনসেপ্ট ছিল আবারও শিল্পী দে-র সৃজনশীল ভাবনা থেকে নির্মিত।
আলো, রঙ, প্রতিমা ও ব্যাকগ্রাউন্ড ডিজাইনের সমন্বয়ে তিনি মঞ্চকে সাজিয়েছিলেন দেবী দুর্গার ঐশ্বরিক উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে —
যেখানে প্রতিটি দিকেই ফুটে উঠেছিল তাঁর রুচি, নান্দনিকতা ও শিল্পভাবনা।
এক উৎসব, এক পরিবার, এক আত্মার বন্ধন
Bengali Puja and Cultural Society of Victoria (BPCSV) আজ শুধু একটি পুজো কমিটি নয় —
এটি এক পরিবার, এক সমাজ ও এক সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রতীক।
এখানে প্রতিটি সদস্য, প্রতিটি স্বেচ্ছাসেবক এবং প্রতিটি শিল্পী একসঙ্গে কাজ করেন
বাংলা সংস্কৃতি, ভক্তি ও মানবিকতার আলোকবর্তিকা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে।
এই দুর্গোৎসব আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় —
“দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে থেকেও, ভক্তি ও সংস্কৃতির সুর কখনও থামে না।”


